প্রত্যেক রবিবার এর মত আশীষ নিজের বারান্দার দরজার পাশের জায়গা ধরে রাস্তার দিকে দেখতে শুরু করল। রুমা তাকে হাজারবার বুঝিয়েছে যে সে যত সকালে উঠুক না কেন আমান ঠিক সময় আসবেই। আমান আশীষের নিজের সন্তান না কিন্তু তার থেকে কমও না। আশিসের একমাত্র দাদার ছেলে আমান। আশিসের নিজের কোনো সন্তান নেই কিন্তু তাতে সে এতোটুকুই দুঃখ পায় না কারণ সে সব দুঃখ আমান ঘুচিয়ে দিয়েছে। আমানের বাবা মারা যাওয়ার পর আমান আশীষকেই নিজের বাবা মেনে নিয়েছে। আমান দিল্লি শহরের নামকরা উকিল দের মধ্যে একজন ।তার মাও কলকাতার বড় উকিল ছিলেন কিন্তু বয়সের জন্য এখন ঘরবন্দি। সারা সপ্তাহ কাজে-কর্মে থাকলেও রবিবার আমান আশীষ আর রুমা সাথেই কাটায়। সন্ধ্যাবেলা যাওয়ার আগে যখন আমান আর আশীষ কথা বলে তখন প্রত্যেক বারের মত আশীষ শুধু আমানকে একটা কথাই বলে," বাবুন এবার তো বিয়েটা করে নে"। আমানের বাড়ির নাম বাবুন। এ কথার উত্তরে আমানও সেই একই কথাই বলে," কাকাই তুমিতো জানো আমার বিয়ে হয়ে গেছে"। এর পরিবর্তে আশীস বলে ,"এটা কোন ধরনের বিয়ে না বাবুন এসব পাগলামি বন্ধ করো যে বউয়ের এক দিনো টিকে না সেই বইয়ের জন্য সারাজীবন একা থাকা পাগলামি"। কিন্তু এই কথার যেকোনো উত্তর আমান দেবে না সেটাও আশীষ ভালো করেই জানে। বাড়ি ফিরে আমান নিজের অফিস ঘরে বসে থাকে। মায়ের অসুস্থতার জন্য এখন আমার অফিসটা বাড়িতে শিফ্ট করে নিয়েছে ।সারা সপ্তাহ সে এমন ভাবে কাজ করে যেন তার কাছে নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় নেই সে এমন ভাবে ঘুরে বেড়ায় যেন সে সারা পৃথিবীর কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। যদিও এসব শুধু গত পাঁচ বছরের গল্প তার আগে আমান তো অন্য মানুষ ছিল।পাঁচ বছর আগে আমান তার মায়ের সাথে থাকত না। যা আজকে কেউ বিশ্বাসও করতে পারবে না ।এখন যে আমান নিজের মায়ের উপর জীবন দেই সেই আমান নাকি তার মায়ের সাথে দেখাও করতো না। তারা তখন কলকাতায় থাকত তখন পরিস্থিতি একেবারে আলাদা ছিল। এখন লোকজন ভুলে গেলেও তখন লোকেরা আমানকে 13 বছর বয়সে খুন করে 8 বছর জেল খেটে আসা ছেলে বলেছেন চিনতে। কিন্তু সেই আমানযই আজ দিল্লি শহরের নামকরা উকিল। সামনের বুধবার 21 শে ডিসেম্বর যেদিন আমানের জীবন বদলে গেছিল। এই দিনটা আমানের জন্য সবচেয়ে খুশির দিন ঠিক তেমনি দুঃখের দিনও। সারা বছর কলকাতা না গেলেও সেই দিন আমান অবশ্যই কলকাতা যায়। তাই মঙ্গলবার সকালেই আমান কলকাতার জন্য রওনা হল।গিয়ে তাদের সেই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে উঠলো। সেই বাড়িতে এখন কেউ থাকে না।আমান শুধু বাগানের ওই বড় ফুলের গাছটাকে দেখতে থাকে। কিন্তু এ বছর মনে হয় সেরকম হবে না। দুপুর বেলার দিকে আমান কারোর পায়ের শব্দ শুনে অবাক হলো। কারণ এখানে তো কারও আসার কথা নয়। আমান ভাবলো সে ভুল শুনেছে। কিন্ত কিছুক্ষণ পর আবার সেই শব্দ শোনা গেল তবে এবার তা আরো জোরালো। আমান ঘুরে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু তার মুখে কোন কথা নেই। যেন ভুত দেখলো। তারপর কিছুক্ষণ পর সে বলল," আপনি এখানে ?আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?"। এই লোকটিকে আমানের ভালো ভাবে চেনা। এই লোকটির জন্যই তো আমানের প্রথম ঋতযার সাথে দেখা হয়েছিল। ঠিক এই দিনে 6 বছর আগে।
(6 বছর আগে)
6 বছর আগে আমান খুনি অপবাদের সাথে মৃত্তিকা সোসাইটি নামে এক সোসাইটিতে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন শান্তিতে থাকার পর ঠিক এই দিনে ছয় বছর আগে সকালবেলা আমানের ফ্ল্যাটের দরজায় শব্দ হয় ,নক! নক! দুচারবার আওয়াজ করার পর যখন আমানের ঘুম ভাঙ্গে দরজা খুলতেই সে দেখে দরজার উপরের 40 বছর বয়সী লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমানের কিছু বলার আগেই তিনি বললেন," আমি শ্রীতনু রায় এই সোসাইটির সেক্রেটারি।আজ দুপুর বেলা বারোটার সময় সোসাইটির হলঘরে মিটিং আছে ।দয়া করে ঠিক সময়ে চলে আসবে।" তার বলার ধরন শুনে বুঝতে বাকি ছিল না যে মিটিং এর বিষয়বস্তু আর কেউ না বরং আমান। বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মিটিং শুরু হলো। শ্রীতনু বাবু বললেন," আমি কিছুদিন সোসাইটিতে না থাকলে কি তোমরা এক খুনি কে এখানে থাকতে দিবে।" আমানের এখন এসব কথা শুনে কিছু হয়না। শ্রীতনু বাবুর কথা আর কেউ কোন উত্তর দিল না। কারণ এতদিনে অনেক জনই তাকে এখান থেকে বের করার চেষ্টা করেছে। তবে সবাই আমানের প্রভাবশালী মায়ের ক্ষমতার দ্বারা হার মেনে নিয়েছে। শ্রীতনু বাবুর হার্টের সমস্যা থাকায় তিনি বেশি উত্তেজিত হলে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। তাই স্বভাবদোষে সেই সময়ও তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন পিছনে লাইন থেকে একজন গিয়ে তাকে তার ওষুধ খাওয়াই। খোলা বড় চুল, মাঝারি লম্বা, গায়ের রং ফর্সা ও মায়াবী চোখ। এইরকম একটি মেয়ে যখন মঞ্চে উঠে শ্রীতনু বাবুকে ওষুধ খাওয়ালো তখন সবার পরিচিত এই মেয়েটি, শ্রীতনু বাবুর কাছ থেকে মাইক নিয়ে বলল," বাবার অসুস্থতার জন্য আজকের মিটিং এখানেই শেষ। আর মিস্টার আমান আপনি এখানে থাকতে পারেন কিন্তু কারো অসুবিধা না করে।" আমানকে একটা কথাও বলতে হলো না। কিন্তু সেই মায়াবী চোখ আমান কিছুতেই ভুলতে পারছিল না।তাকে দেখে আমানের মনে হচ্ছিল যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিস সে পেয়ে গেছে। তাই সে শ্রীতনু বাবুর বাড়ির খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলো। জানতে পারলো শ্রীতনু বাবুর বাড়িতে 4 জন লোক। প্রথম মিস্টার শ্রীতনু রায় ,এক্স আর্মি অফিসার। দ্বিতীয় ঋষা রায়, আগে স্কুলশিক্ষিকা হলেও এখন গৃহবধূ ।তৃতীয় ও চতুর্থ ঋতজা রায় ও অদ্রিজা রায়। ঋতজা একটা এনজিওর সাথে কাজ করে, যারা ছোট শিশুদের সাহায্য করে ।ও এক লাইব্রেরিতেও কাজ করে। অদ্রিজা ইঞ্জিনিয়ার। ঋতজা অদৃজার থেকে দু বছরের বড়।কিন্তু অদৃজা নিজের জন্য ছেলে দেখে রেখেছে। তবে শ্রীতনু বাবু জেদ ধরে বসে আছেন যে আগে ঋতজারই বিয়ে হবে তারপর অদ্রিজার। কিন্তু দশটা ছেলে দেখেও কাউকে তার পছন্দ হয়নি। তার কাউকে নিজের মেয়ের জন্য যোগ্য বলে মনে হয় না।
আমান কারো সাথে তেমন কথা বলে না ।কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে বাইরে জোর আওয়াজ। সেই শুনে আমান বাইরে এলো। শ্রীতনু বাবুরা আমানের সামনের ফ্ল্যাটে থাকে। বাইরে বেরিয়ে দেখলো সোসাইটির সব লোক শ্রীতনু বাবুদের বাড়ির সামনে হুল্লোড় করছে। দরজার কাছে সবাই এমনভাবে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, যে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর যখন সবাই চলে গেল তখন আমান দেখল মিসেস রায় কাঁদতে কাঁদতে দরজার কাছে লুটিয়ে পড়েছেন অদ্রিজা তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।আর ঋতজা এদিক থেকে ওদিক হাঁটছে আর কাকে যেন ফোন করছে। কিন্তু আমান কি হয়েছে জানার জন্য যখনি এগিয়ে গেল তেমনি ঋতজা দরজাটা বন্ধ করে দিল। ঋতজা আমানকে ঠিক পছন্দ করে না সেটা তার আচরণে স্পষ্ট। অন্য দিকে কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমান তাদেরকে কি হয়েছে বলার জন্য অনুরোধ করে। তারা জানায় যে কাল রাত থেকে শ্রীতনু বাবু বাড়ি ফেরেননি। তাই পুলিশ স্টেশনের মিসিং রিপোর্ট লিখতে গিয়ে জানা যায় কালরাত্রি শ্রীতনু বাবুর গাড়ির সাথে একটি গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। যার জন্য ওই গাড়ির লোকটা মারা যায়। তাই কাল রাত থেকে শ্রীতনু বাবু লকআপ এ আছে। এখন সব সোসাইটির লোক মিলে তাকে ফ্ল্যাট খালি করার কথা বলতে গিয়েছিলো। কাল সকালের মধ্যে তাদেরকে ফ্ল্যাট খালি করতে হব সব শুনে আমান সাহায্য করতে চাইলেও করতে পারবে না। কারণ তারা আমানের কোন সাহায্য নেবে না। তাও সে তাদের কাছে গেল দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলল ঋতজা আমানের কিছু বলার আগে সে বললো," কি চাই সবাই তো এসো একবার বলল। কালকে চলে যাব আবার আপনি কেন অপমান করতে এসেছেন। দয়া করে চলে যান।" এই বলে ঋতজা আবার আমানের মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমান কিছু করতে না পেরে নির্বাক শ্রোতা সেজে বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু ভগবানের সেটা মঞ্জুর ছিল না তাই সন্ধ্যার দিকে আমানের বাড়ির দরজায় আওয়াজ হলো। আমান দরজা খুলতেই দু চোখ ভরা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঋতজা। তার হাতে কয়েকটা কাগজপত্র নিয়ে ঋতজা দাঁড়িয়েছিল। আমানকে দেখেই সে আরও কাঁদতে লাগল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,"আমাকে ক্ষমা করে দিন আমি আপনাকে অনেক অপমান করেছি।আমি আজ খুব অসহায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি।" আমানেরর কান্নাকাটি করে এমন মেয়ে একবারে পছন্দ না, কিন্তু আজ ঋতজার চোখের জল দেখে তার মনে হলো যেন তার বুকের ভেতর যেন কেউ সুচ ফোটাচ্ছে। সে বলল," তুমি মানে আপনি ভিতরে আসুন আর সবার প্রথমে কান্না বন্ধ করুন, আমি জল নিয়ে আসছি দিয়ে কি হয়েছে সেটা বলুন।" প্রথমের না বললেও পরে ঋতজা ঘরে এসে বসলো। আমান একা থাকলেও সে যে বেশ পরিষ্কার সেটা তার বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। জল খেয়ে চোখ মুছে ঋতজা বলল ,"আমার বাবা কিছু করেননি। বাবাকে কিছু না জেনেই ফাঁসানো হচ্ছে। যেই ছেলেটি মারা গেছে সে আগে থেকে নেশা করে গাড়ি চালাচ্ছিল। বাবার গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগলেও বাবার কোন দোষ নেই। ওই ছেলেটি ভুল দিক থেকে আসছিল।আর যে কেস করেছে সে নাকি মস্ত বড় লোক। মিস্টার রায়চৌধুরী নামে কেউ জানিনা ঠিক। কিন্তু ওর নাম শুনেই কোন উকিল কিস নিতে চাইছে না। বলছে ওর নাকি অনেক ক্ষমতা। আমাকে একজন বলল আপনার মা মানে মিসেস লতিকা সিংহ মিস্টার রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে কেস টা নিলেও নিতে পারে। কিন্তু তার বাড়িতে গেলে তার সেক্রেটারি বলে আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দেয়। উনি তো আপনার মা, আপনি যদি একটু বলতেন তাহলে খুব সাহায্য করতো তাহলে আমি আমার বাবা কিছুতেই বাঁচাতে পারবো না।" এই বলে সে আবার কাঁদতে শুরু করলো সব শুনে আমান যেন এক অন্য পৃথিবীতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সে বলল," আপনারা থাকার ব্যবস্থা করেছেন?" ঋতজা না বললে আমান তাদের সাহায্য করতে চাইলেও কিছু বলল না। " ঠিক আছে আমি দেখছি যে আমি কি করতে পারি", এই বলে আমান মনে হয় অন্য কোন একটা কথা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই ঋতজা উঠে চলে গেল আমানের আর কোন কথাও বলা হলো না। পরদিন সকালে ঋতজা সোসাইটির লোকের কাছ থেকে আরও দু'দিন সময় নিয়ে নিলো।আমান ঋতজা যাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে নাই। সকালে সে ঋথজাকে ফোন করলো বললো," হ্যালো! বলছিলাম মিস্টার রায় চৌধুরীর সাথে আমি মিটিং ঠিক করেছি। কিন্তু উনি করে পরিবারের লোকের সাথে কথা বলতে চান না। তো যদি আপনি চান তাহলে কি আমি উনার সাথে কথা বলতে পারি?" ঋতজা বলল,"না না এটাতে অসুবিধার আবার কি আছে।" এই বলেই আমান ফোনটা কেটে দিলো। দিয়ে সারাটা দিন কেটে গেলো পরে তোকে ফোন লাগালেও তার ফোন সুইচ অফ ছিল। সারারাত ঋতজা ঘুমাতে পারল না। সে শুধু ভাবছিল যে আমান কি তাকে মিথ্যা আশ্বাস দি কিন্তু সকাল বেলা পুলিশ ঋতজার এলো। তাদের দেখে ঋতজারা ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তারা বলল মিস্টার রায়চৌধুরী কেসটা ফেরত নিয়ে নিয়েছে। আপনার বাবা নির্দোষ। একদিনে আপনাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী আমাদের ক্ষমা করবেন। এই বলে তারা শ্রীতনু বাবুকে বাড়িতে পৌঁছে চলে গেলেন। শ্রীতনু বাবুকে দেখে সবাই একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। কাল যেসব লোকেরা ওদের ফ্ল্যাট খালি করতে বলেছিল তারা এসে বলল আমরা তো জানতামই যে স্ত্রীতনু বাবু এরকম কাজ করতেই পারেন না। ঋতজা পরিষ্কার বুঝতে পারল এসব আমান এরই কান্ড। কিন্তু সে এখনো বাড়ি ফেরেনি। শ্রীতনু বাবু নির্দোষ হয় বাড়ি ফিরেছেন বলে ঋতজা সন্ধ্যা বেলা সবাই কে বাড়িতে ডেকে পার্টি দিল। আমান না থাকায় তাকে ফোন করলেও সে ফোন ধরেনি। তাই তাকে মেসেজ করে কিন্তু তাতেও সে আসেনি। সব আনন্দের মুহূর্তে ঋতজা এর চোখ শুধু আমানকেই খুঁজছিল। সে তার বাবাকে আমানের সাহায্যের ব্যাপারে বলল। তার বাবাও তাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য আমান কে ফোন করে কিন্তু সে ফোন ধরে না।