রাত ১২টা, কথাটা শুনলেই বোঝা যায় চারিদিকের নিস্তব্ধতা ও অন্ধকার কতটা গভীর। যেকোনো ছোটোখাটো শব্দও এই সময়ে তার বিশাল ব্রহ্ম-দৈত্যের আকার নেয়। সেটা যদি কোনো মানুষ একটিবার শুন'তো তাহলে তার সারাজীবনের ঘুম উড়ে যেত। তাই হয়তো এই ভয়াবহ সময়টাতে মানুষ তো বটেই, পশু-পাখিও গভীর ঘুমে মগ্ন। যার ফল স্বরূপ তাদের ঘুমটা আজও অব্যাহত। তবে আজকাল দেখি নিশাচর প্রাণীদের মতোই কিছু মানুষ, এই মধ্য রাতেও জেগে! যেন ব্রক্ষ্ম'দৈত্যের শব্দ খানি তাদের বাগে পেয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাই তাদের চোখে ঘুমের ' ঘ ' টুকু নেই। এই অবস্থার কোনো জরিবুটি না পাওয়ায় যেন বসে থাকে টেলিভিশনের সামনে। আর তার কাছে প্রার্থনা করার পর খনিকে খনিকে দরজার পানে চায়। যদি কোনও ফারিস্তা একমুঠো ঘুম দান করে যায়, তাহলে সে বেডে গিয়ে ঘুমের সমুদ্রে ডুব দেয়!
এমনই এক টেলিভিশনে ভূতের সিনেমা চলছে, সামনে চারটি চেয়ার, তাতে একে একে চারজন বসে। তবে আশ্চর্য ,চারজন থাকা সত্ত্বেও ঘরটা খুবই শান্ত। বাইরে থেকে কেউ গেলে ভাববে হয়তো টি.ভি. বন্ধ না করেই সব ঘুমিয়ে পড়েছে। মানে এমন একটা পরিবেশ যেখানে যেকোনো ভদ্র ভূতের মন নিসফিস করবে ভেতরে ঢুকে নৃত্য করার। কিন্তু ভেতরে আসলেই সে তার প্রাণ হারাবে, এই নিস্তব্ধ নিশাচরদের দেখে।
প্রায় চোদ্দো বছরের একটি ছেলে, মাথায় কিছুটা চুল। চাইলেই তা গুনতি করা সম্ভব, খুব যে একটা সহজ ব্যাপার তাও না, এক-আধটু জটিলতা আছে। সে কয়েকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে তার পাশের জনকে বলল,
-- আচ্ছা বাসুদা, টেলিভিশনের ভূতের সিনেমাগুলো কী সত্যি?
বাসুদার পাশের বছর পনেরোর ছেলেটা মাথায় উস্কো খুস্কো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-- না না রিঙ্কু। এগুলো জাস্ট মানুষের থিঙ্কিং , যা কাজে লাগিয়ে লেখকেরা ও তান্ত্রিকেরা পয়সা ছাপে। বলতে গেলে কিছু পপুলারিটি পাওয়ার জন্য, কিছু আনন্দ দেওয়ার জন্য। তার বেশি কিছু না।
এবার শেষের ষোলো বছরের ছেলেটি বলল,
-- নিলম, তুই দেখছি সবই জানিস! তা ভূত যদি না থাকে তাহলে লেখকদের মাথায় এসব আসল কী করে? আর লোকেদের যে ভূতে ধরে সেটাই বা কী?
-- হুম্, বোনি ঠিকই বলেছে। এখন বল কি করে আসলো? ; রিঙ্কু, নিলমকে জিজ্ঞেস করল।
ক্ষমা করবেন আমার পরিচয় দেওয়া হয় নি। আমি, বাসেদ সরকার, সবাই বাসুদা বলেই ডাকে। ছোটবেলা ঠাকুমা বাসু নামে ডাকতেন। ছোটো থেকে টেনিদা আর ফেলুদা'র গল্প পড়ে পড়ে তারাও কিছু করতে চায়। কোনো দুঃসাহসী অভিযান করতে চায়, প্রতিপক্ষকে এক'ঘা মেরে বাজিমাত করতে চায়। তাই তারাও ঠাকুমার সাথে আমাকে বাসুদা বলে ডাকে, তারপর ধিরে ধিরে সবাই। তারা তাদের দুঃসাহসী দল'তো বানিয়ে ফেলেছে, শুধু অভিযানের কিছু হয়নি! যাইহোক রাতটায় ফিরে আসি, কোনোদিন সময় পেলে সব গল্প হবে।
এই পর্যন্ত ওদের কথা কানে নিই নি। গভীর মনোযোগে টেলিভিশনে সিনটা দেখছিলাম। কিন্তু তাদের বিতর্কে বিরক্ত হয়ে দাবড় দিয়ে বললাম,
-- আহ্, তোরা থামবি! ভূত আছে কি না আছে পরে দেখা যাবে। এখন সিনেমাটা দেখতে দেতো!
সবার মধ্যে আমিই বড়ো, আবার দলের মূখ্য সদস্য, তাই তারা আমার কথা ফেলেনা। দেখি, দাবড়ের দরূন ঘরটা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু, টেলিভিশনে যে সিনেমাটি চলছিল তাতে নায়ীকার পেছনে হঠাৎ মরাটা যেন উড়তে থাকে। পিছনে ফিরে নায়ীকা তা দেখে প্রবল চিৎকার শুরু করে। ফলে পুরো ঘরের স্তব্ধতা নিমেসেই হারিয়ে গেল।
রাত ২টা, এই সময় সিনেমাটির আসল মজা। কিন্তু, তখনই বাত্তিগুল মানে বিদ্যুৎ চলে গেল। বর্তমানে এটা স্বাভাবিক, পূজো ছাড়া আজকাল সবসময় বিদ্যুৎ থাকে না। বিশেষ করে গরমের সময়, রাত হলেই বিদ্যুৎ বলে," বাবু মশাই আসি তাহলে " ! মানে সমস্ত এক্সাইটমেন্ট মাটিতে মিশিয়ে উনি নাচতে নাচতে চলে গেলেন! কিছু করার সাধ্য না থাকায় হতভাগা চারজনই অন্ধকারে নির্বাক হয়ে চেয়ারেই বসে রইলাম। ফলে ঘরটা আবার স্তব্ধ ও শান্ত হয়ে গেল। একে অন্ধকার তার ওপর নিস্তব্ধতা, বাড়ির উইপোকাও যেন হিংসায় জ্বলতে লাগল। তাই রাগ সামলাতে না পেরে দরজার কাঠ কাটছে।
বোনি, রিঙ্কু ও নিলমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভীতু বোনি আর সাহসী রিঙ্কু। দরজায় শব্দ শুনে বোনি ভয় পেয়ে গেছে। কারণ, আমি একটু দূরে বসে আছি। বোনিকে ভয় দেখানোর জন্য রিঙ্কু ও নিলম মেঝেতে শব্দ করতে লাগল। বোনি ভয়ে আর্তনাদ শুরু করল এবার,
-- তোরা থামবি। বাসুুদা এদের কিছু বলো। খুব বাড়াবাড়ি করছে কিন্তু।
কিন্তু আমার তাদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, আমি বাইরে কিসের যেন শব্দ পাচ্ছি। একদম অচেনা এক শব্দ। না পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, না কথা থেকে আসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাই চুপ করে শব্দটিকে অনুধাবন করতে লাগলাম...